ঢাকা ০৫:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম :
Logo ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে আগুন Logo ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য চায় সরকার Logo নির্বাচন আয়োজনে কমনওয়েলথের সহযোগিতা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা Logo চ্যালেঞ্জ হলেও গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একদিনে হওয়া উচিত: অর্থ উপদেষ্টা Logo সালমান এফ রহমানের ৩৬ বিঘা জমি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ Logo ফের কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন স্বাস্থ্য সহকারীরা Logo আগামী জুলাই থেকে সব প্রতিষ্ঠানে ক্যাশলেস লেনদেন হবে: গভর্নর Logo বিভক্তির কারণে সাংবাদিকেরা রাজনীতিকদের পকেটে ঢুকে যান: মির্জা ফখরুল Logo আকাশের যত তারা, সাংবাদিক নিবর্তনে আইনের তত ধারা: অ্যাটর্নি জেনারেল Logo ৪১ দেশে ৪১ শতাংশ আইসিইউ রোগীর শরীরে কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক: আইইডিসিআর

ক্লাস অনুযায়ী জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সপ্তম শ্রেণির সমান মান এইচএসসি উত্তীর্ণদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০৭:৫৯:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
  • / 145

বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত মান নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনেকটাই আন্তর্জাতিক মানের নিচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা গড়ে আন্তর্জাতিকভাবে সপ্তম শ্রেণির সমতুল্য জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জন করছেন। বিষয়টি শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা শেখার মান বিবেচনায় এর মধ্যে কেবল ৬.৫ বছরের সমতুল্য শিক্ষাই অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, শিক্ষাবর্ষ (Learning-Adjusted Years of Schooling) অনুযায়ী বাংলাদেশ অন্তত ৪.৫ বছর পিছিয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশুর ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সম্পন্ন করার কথা। তবে শেখার গুণমান ও দক্ষতা বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মাত্র ৬.৫ বছর সমতুল্য মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে চার বছরের মানঘাটতি বিদ্যমান, যা শিক্ষার গুণগত দুর্বলতার একটি বড় প্রমাণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন শিশু যদি ৪ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে ১৮ বছর বয়সে তার আনুষ্ঠানিকভাবে ১০.২ বছর শিক্ষা সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু শিক্ষার গুণমান বিবেচনায় সে প্রকৃত অর্থে শুধু ৬ বছর সমমানের শেখা অর্জন করছেন। অর্থাৎ, শেখার গুণমানের বিচারে ৪.২ বছরের ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে অবগত শিক্ষা প্রশাসন। তারা বলছে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। এসব প্রতিকূলতার কারণে সামাগ্রিক শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে না। তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে তারা কাজ করছেন। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বেতন বৃদ্ধিসহ নানা জায়গায় কাজ করছেন। হঠাৎ করেই শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সময় প্রয়োজন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিলেবাস, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের মানের ঘাটতি রয়েছে। এই জায়গাগুলো উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে। হঠাৎ করে বেতন বাড়িয়ে দিলে তো হবে না। প্রাইমারি থেকে যারা মাধ্যমিকে আসে তাদের শেখার মান যথাযথ নয়। শিখন ঘাটতি নিয়েই তারা উচ্চমাধ্যমিকে যাচ্ছে। ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। আমরা ডিজিটাল শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছি। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। শেত্বপত্র প্রণয়ন কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। সে সুপারিশগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মাসুদ আকতার খান বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার যে ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে মন্ত্রণালয় অবগত। কীভাবে এ ঘাটতি দূর করা যায় সেই পথ বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের উপদেষ্টা এবং সচিব ভালো বলতে পারবেন।’

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সমন্বিত আন্তর্জাতিক টেস্ট স্কেলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গড়পড়তা ৩৬৮ স্কোর করেছে, যেখানে ৬২৫ স্কোর মানে ‘উন্নত অর্জন’ এবং ৩০০ স্কোর মানে ‘ন্যূনতম অর্জন’। এই স্কোর নির্দেশ করে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ, লেখালেখি ও গণিতের মতো মৌলিক দক্ষতায় দুর্বল, যা শিক্ষার প্রকৃত মান হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ।

বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ৫ বছর প্রাথমিক, ৫ বছর মাধ্যমিক এবং ২ বছর উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ১২ বছরের শিক্ষা সম্পন্ন করে। অথচ শেখার মানদণ্ডে আন্তর্জাতিকভাবে তারা মাত্র সপ্তম শ্রেণির সমমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করছে। এই ব্যবধান শুধু সংখ্যার ঘাটতি নয়, বরং শিক্ষার প্রকৃত গুণগত দুর্বলতা এবং জ্ঞান অর্জনের অসারতা প্রকাশ করে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো দেশই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘাটতি শুধু আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম শেষ করায় নয়, বরং শিক্ষার্থীর বাস্তব জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমন্বিত চিন্তার অভাবেই তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এইচএসসি পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না। ভর্তির পর রচনামূলক প্রশ্ন বুঝতে পারেন না। প্রোগ্রামিং, গণিত বা গবেষণাভিত্তিক বিষয়গুলোতে ভয়াবহ ঘাটতি দেখা যায়। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখস্থনির্ভর পাঠদান, পরীক্ষাভিত্তিক মেধা যাচাই, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিশ্লেষণধর্মী শেখার অভাব এবং প্রশিক্ষণহীন বা নিম্নদক্ষ শিক্ষকদের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন কমন পড়া বা গাইড বইয়ের মুখস্থ জবাব দিয়েই উত্তীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক মানে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ। এর অন্যতম কারণ-শিক্ষকদের যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠদান না দেওয়া।

তারা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। সংকটে নিরসনে পাঠ্যক্রমে বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। একইসঙ্গে পরীক্ষার ধরনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার গুণমান মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় যে ধরনের বিনিয়োগ করা দরকার ছিল সেটি করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রাথমিকের শিক্ষকরা মোটিভেটেড না। তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শেখাতে পারছেন না। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিক্ষকতার বাইরে নানা কাজের সাথে যুক্ত। ফলে সেই কাজগুলো সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান দিতে পারছেন না। যার ফলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন হচ্ছে না। শিখন ঘাটতি নিয়েই শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবেশ করছেন। পরবর্তীতে এই ঘাটতি আর পূরণ হচ্ছে না।’

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই জানিয়ে অধ্যাপক আমানুল্লাহ আরও বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি পড়তে পারেন না, গণিতে দুর্বল। এর প্রধান কারণ শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো কীভাবে শেখাতে হবে সেটি শিক্ষকরা জানেন না। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ ক্ষোভ নিয়ে তারা শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিতে পারছেন না। এ বিষয়গুলো দূর না হলে শিখন ঘাটতি থেকেই যাবে।’

 

আমাদের কিছু বেঞ্চ মার্ক রয়েছে, যেগুলো আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমাদের শিক্ষার মান কোথায় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মনিনুর রশিদ বলেন, ‘ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে। এর কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি। এই ঘাটতি একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত কয়েকযুগ ধরে পাশের হার বেশি দেখানো হয়েছে। যোগ্য শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা সঠিক পাঠদান পায়নি। আমরা ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাই না। কারণ তারা বেশি বেতন ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। ভালো শিক্ষক না হলে শিক্ষার্থীরা শিখবে কীভাবে? প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন, তাদের অধিকাংশই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা হয় না। ফলে শিক্ষকদেরও শিখন ঘাটতি থেকে যায়। সেই ঘাটতি নিয়েই তারা পাঠদান দেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরাও সেভাবে শিক্ষা পায় না।’

শিক্ষায় অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্ট দরকার জানিয়ে ঢাবির আইইআর-এর এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হলে শিক্ষার মান উন্নত হত। তবে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আপনি ১২ হাজার টাকায় শিক্ষকতা পেশায় নিতে পারবেন না। তাকে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এজন্য শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ দরকার। তবে আমরা বিনিয়োগ করি ভিন্নখাতে। ঘন ঘন কারিকুলাম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু না শিখে কেবল মুখস্ত করে। আইসিটি, গণিতের মতো বিষয় মুখস্ত করে পরীক্ষা দেয়। এগুলোর কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিম্নমুখী।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর পরিচালক প্রফেসর ড. গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারায় আমাদের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তারা শিক্ষাগ্রহণের পরও সেভাবে ফল পাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের কেবল জিপিএ-৫ এর জন্য অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। সেজন্য তারা মৌলিক শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে ভালো নম্বরের আশায় মুখস্ত করছেন। মুখস্তবিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াে গেলেও পরবর্তী ধাপে গিয়ে তারা উত্তীর্ণ হতে পারছেন না।’

গ্রাম এবং শহর অঞ্চলের পাঠদানের পার্থক্য অনেক জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো পাঠদান পেলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক শিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে। যার কারণে বৈশ্বিকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষকরা শিক্ষকতায় আগ্রহ পাবেন। শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নে এটি সহায়ক হবে।’

 

শিক্ষার মানের ঘাটতি অর্থনীতিতে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব

বাংলাদেশে গত দুই দশকে শিক্ষায় পরিমাণগত অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় হলেও গুণগত ঘাটতি এখন জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ বলছে, শিক্ষার্থীদের দুর্বল মৌলিক দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতার অভাব এবং সমস্যা সমাধানের অক্ষমতা দেশের শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি তৈরি করছে। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাগত দুর্বলতা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হ্রাস করছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের পথেও বড় বাধা তৈরি করছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ইস্ট এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সফল হয়েছে, বাংলাদেশকেও সে পথে এগোতে হলে শিক্ষার গুণগত মানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, সেই দেশেই শিক্ষার গুণগত দুর্বলতা ভবিষ্যতে অগ্রগতিকে শ্লথ করতে পারে।

মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক

মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স (HCI) অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ১৫৭টি দেশের মধ্যে ছিল ১০৬তম অবস্থানে। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৪৮ অর্থাৎ, যদি বর্তমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে আজকের একটি শিশু ভবিষ্যতে তার সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতার মাত্র ৪৮ শতাংশ অর্জন করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে শিক্ষাকে শুধু সংখ্যা বা সনদের ভিত্তিতে নয় দক্ষতা, ব্যবহারিক জ্ঞান এবং বিশ্লেষণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গুণগতভাবে উন্নত করতে হবে। শিক্ষার মানঘাটতি শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ফল। পাঠ্যবই মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর পেলেও বাস্তব জীবনে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু পরীক্ষা-নির্ভর শিক্ষা নয়, বরং বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী পাঠদান পদ্ধতি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ক্লাস অনুযায়ী জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সপ্তম শ্রেণির সমান মান এইচএসসি উত্তীর্ণদের

আপডেট সময় : ০৭:৫৯:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত মান নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনেকটাই আন্তর্জাতিক মানের নিচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা গড়ে আন্তর্জাতিকভাবে সপ্তম শ্রেণির সমতুল্য জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জন করছেন। বিষয়টি শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা শেখার মান বিবেচনায় এর মধ্যে কেবল ৬.৫ বছরের সমতুল্য শিক্ষাই অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, শিক্ষাবর্ষ (Learning-Adjusted Years of Schooling) অনুযায়ী বাংলাদেশ অন্তত ৪.৫ বছর পিছিয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিশুর ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (১ম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সম্পন্ন করার কথা। তবে শেখার গুণমান ও দক্ষতা বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মাত্র ৬.৫ বছর সমতুল্য মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে চার বছরের মানঘাটতি বিদ্যমান, যা শিক্ষার গুণগত দুর্বলতার একটি বড় প্রমাণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন শিশু যদি ৪ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে ১৮ বছর বয়সে তার আনুষ্ঠানিকভাবে ১০.২ বছর শিক্ষা সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু শিক্ষার গুণমান বিবেচনায় সে প্রকৃত অর্থে শুধু ৬ বছর সমমানের শেখা অর্জন করছেন। অর্থাৎ, শেখার গুণমানের বিচারে ৪.২ বছরের ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে অবগত শিক্ষা প্রশাসন। তারা বলছে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। এসব প্রতিকূলতার কারণে সামাগ্রিক শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে না। তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে তারা কাজ করছেন। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বেতন বৃদ্ধিসহ নানা জায়গায় কাজ করছেন। হঠাৎ করেই শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সময় প্রয়োজন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিলেবাস, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের মানের ঘাটতি রয়েছে। এই জায়গাগুলো উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে। হঠাৎ করে বেতন বাড়িয়ে দিলে তো হবে না। প্রাইমারি থেকে যারা মাধ্যমিকে আসে তাদের শেখার মান যথাযথ নয়। শিখন ঘাটতি নিয়েই তারা উচ্চমাধ্যমিকে যাচ্ছে। ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। আমরা ডিজিটাল শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছি। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। শেত্বপত্র প্রণয়ন কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। সে সুপারিশগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মাসুদ আকতার খান বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার যে ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে মন্ত্রণালয় অবগত। কীভাবে এ ঘাটতি দূর করা যায় সেই পথ বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের উপদেষ্টা এবং সচিব ভালো বলতে পারবেন।’

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সমন্বিত আন্তর্জাতিক টেস্ট স্কেলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গড়পড়তা ৩৬৮ স্কোর করেছে, যেখানে ৬২৫ স্কোর মানে ‘উন্নত অর্জন’ এবং ৩০০ স্কোর মানে ‘ন্যূনতম অর্জন’। এই স্কোর নির্দেশ করে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ, লেখালেখি ও গণিতের মতো মৌলিক দক্ষতায় দুর্বল, যা শিক্ষার প্রকৃত মান হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ।

বাংলাদেশের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ৫ বছর প্রাথমিক, ৫ বছর মাধ্যমিক এবং ২ বছর উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ১২ বছরের শিক্ষা সম্পন্ন করে। অথচ শেখার মানদণ্ডে আন্তর্জাতিকভাবে তারা মাত্র সপ্তম শ্রেণির সমমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করছে। এই ব্যবধান শুধু সংখ্যার ঘাটতি নয়, বরং শিক্ষার প্রকৃত গুণগত দুর্বলতা এবং জ্ঞান অর্জনের অসারতা প্রকাশ করে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো দেশই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘাটতি শুধু আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম শেষ করায় নয়, বরং শিক্ষার্থীর বাস্তব জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমন্বিত চিন্তার অভাবেই তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এইচএসসি পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না। ভর্তির পর রচনামূলক প্রশ্ন বুঝতে পারেন না। প্রোগ্রামিং, গণিত বা গবেষণাভিত্তিক বিষয়গুলোতে ভয়াবহ ঘাটতি দেখা যায়। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখস্থনির্ভর পাঠদান, পরীক্ষাভিত্তিক মেধা যাচাই, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিশ্লেষণধর্মী শেখার অভাব এবং প্রশিক্ষণহীন বা নিম্নদক্ষ শিক্ষকদের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন কমন পড়া বা গাইড বইয়ের মুখস্থ জবাব দিয়েই উত্তীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক মানে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ। এর অন্যতম কারণ-শিক্ষকদের যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠদান না দেওয়া।

তারা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। সংকটে নিরসনে পাঠ্যক্রমে বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। একইসঙ্গে পরীক্ষার ধরনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার গুণমান মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় যে ধরনের বিনিয়োগ করা দরকার ছিল সেটি করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রাথমিকের শিক্ষকরা মোটিভেটেড না। তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শেখাতে পারছেন না। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিক্ষকতার বাইরে নানা কাজের সাথে যুক্ত। ফলে সেই কাজগুলো সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান দিতে পারছেন না। যার ফলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন হচ্ছে না। শিখন ঘাটতি নিয়েই শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবেশ করছেন। পরবর্তীতে এই ঘাটতি আর পূরণ হচ্ছে না।’

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই জানিয়ে অধ্যাপক আমানুল্লাহ আরও বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি পড়তে পারেন না, গণিতে দুর্বল। এর প্রধান কারণ শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো কীভাবে শেখাতে হবে সেটি শিক্ষকরা জানেন না। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ ক্ষোভ নিয়ে তারা শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিতে পারছেন না। এ বিষয়গুলো দূর না হলে শিখন ঘাটতি থেকেই যাবে।’

 

আমাদের কিছু বেঞ্চ মার্ক রয়েছে, যেগুলো আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমাদের শিক্ষার মান কোথায় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মনিনুর রশিদ বলেন, ‘ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে। এর কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি। এই ঘাটতি একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত কয়েকযুগ ধরে পাশের হার বেশি দেখানো হয়েছে। যোগ্য শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা সঠিক পাঠদান পায়নি। আমরা ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাই না। কারণ তারা বেশি বেতন ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। ভালো শিক্ষক না হলে শিক্ষার্থীরা শিখবে কীভাবে? প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন, তাদের অধিকাংশই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা হয় না। ফলে শিক্ষকদেরও শিখন ঘাটতি থেকে যায়। সেই ঘাটতি নিয়েই তারা পাঠদান দেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরাও সেভাবে শিক্ষা পায় না।’

শিক্ষায় অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্ট দরকার জানিয়ে ঢাবির আইইআর-এর এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হলে শিক্ষার মান উন্নত হত। তবে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আপনি ১২ হাজার টাকায় শিক্ষকতা পেশায় নিতে পারবেন না। তাকে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এজন্য শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ দরকার। তবে আমরা বিনিয়োগ করি ভিন্নখাতে। ঘন ঘন কারিকুলাম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু না শিখে কেবল মুখস্ত করে। আইসিটি, গণিতের মতো বিষয় মুখস্ত করে পরীক্ষা দেয়। এগুলোর কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিম্নমুখী।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর পরিচালক প্রফেসর ড. গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারায় আমাদের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তারা শিক্ষাগ্রহণের পরও সেভাবে ফল পাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের কেবল জিপিএ-৫ এর জন্য অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। সেজন্য তারা মৌলিক শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে ভালো নম্বরের আশায় মুখস্ত করছেন। মুখস্তবিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াে গেলেও পরবর্তী ধাপে গিয়ে তারা উত্তীর্ণ হতে পারছেন না।’

গ্রাম এবং শহর অঞ্চলের পাঠদানের পার্থক্য অনেক জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো পাঠদান পেলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক শিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে। যার কারণে বৈশ্বিকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষকরা শিক্ষকতায় আগ্রহ পাবেন। শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নে এটি সহায়ক হবে।’

 

শিক্ষার মানের ঘাটতি অর্থনীতিতে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব

বাংলাদেশে গত দুই দশকে শিক্ষায় পরিমাণগত অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় হলেও গুণগত ঘাটতি এখন জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ বলছে, শিক্ষার্থীদের দুর্বল মৌলিক দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতার অভাব এবং সমস্যা সমাধানের অক্ষমতা দেশের শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি তৈরি করছে। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাগত দুর্বলতা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হ্রাস করছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের পথেও বড় বাধা তৈরি করছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ইস্ট এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সফল হয়েছে, বাংলাদেশকেও সে পথে এগোতে হলে শিক্ষার গুণগত মানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, সেই দেশেই শিক্ষার গুণগত দুর্বলতা ভবিষ্যতে অগ্রগতিকে শ্লথ করতে পারে।

মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক

মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স (HCI) অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ১৫৭টি দেশের মধ্যে ছিল ১০৬তম অবস্থানে। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৪৮ অর্থাৎ, যদি বর্তমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে আজকের একটি শিশু ভবিষ্যতে তার সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতার মাত্র ৪৮ শতাংশ অর্জন করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে শিক্ষাকে শুধু সংখ্যা বা সনদের ভিত্তিতে নয় দক্ষতা, ব্যবহারিক জ্ঞান এবং বিশ্লেষণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গুণগতভাবে উন্নত করতে হবে। শিক্ষার মানঘাটতি শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ফল। পাঠ্যবই মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর পেলেও বাস্তব জীবনে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু পরীক্ষা-নির্ভর শিক্ষা নয়, বরং বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী পাঠদান পদ্ধতি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।